Sunday, November 18, 2018

হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে পেতে নতুন প্রকল্প : ফিরে আসছে মসলিন

প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যের কথা আসলেই সবার আগে যার নাম আসে তা হলো ঢাকাই মসলিন। সেই প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবী জোড়া কদর ছিল এই মসলিনের। ফুটি কার্পাস নামের তুলা থেকে প্রস্তুত অতি চিকন সুতা দিয়ে  তৈরি হতো এই মসলিন। মসলিনের সূক্ষ্ম ও মিহি সুতার বুনন শৈলী খুব সহজেই  সকলের মন জয় করে  নিতো। মসলিনের এই সূক্ষ্মতা বুঝাতে লোকমুখে প্রচলিত ছিল নানা জনশ্রুতি । বারো হাতের মসলিন  শাড়িকে একটি দিয়াশলাইয়ের ভিতরে রাখা যেত অনায়াসে। যদিও এই জনশ্রুতির প্রমাণ আজও মিলেনি। লোকমুখে শুনে স্থানীয় মানুষের বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে এই জনশ্রুতি।
‘মসলিন’ শব্দের উৎপত্তির উৎস অস্পষ্ট। কেউ বলেন, মসলিন শব্দটি ইরাকের একটি প্রাচীন ব্যবসা কেন্দ্র মসুল থেকে উদ্ভূত। আবার কেউ কেউ মনে করেন, দক্ষিণ ভারতে ইউরোপীয় বাণিজ্যিক কোম্পানির এককালের সদর দপ্তর মসলিপট্টমের সঙ্গে মসলিন শব্দটি সম্পৃক্ত। মসলিন ফার্সি, সংস্কৃত বা বাংলা শব্দ নয়। সম্ভবত ইউরোপীয়রা মসুল থেকে যেসব বস্ত্র আমদানি করত এবং প্রাচ্যের অপরাপর দেশ থেকে মসুল হয়ে যেসব বস্ত্র আনা হতো তারা তার নাম দেন মসলিন।
সেই ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন আবার ফিরে আসবে। দেশের তাঁতিরা মসলিন কাপড়ের মিহি বুননে শৈলী ফুটিয়ে তুলবেন। মসলিন আবারও জনপ্রিয় হবে। ফিরে আসবে সোনালি ঐতিহ্য। এরকম স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড। এ জন্য মসলিনের সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধারে নতুন গবেষণাধর্মী প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি পাস করা হয়েছে।
মসলিনকে ফিরে পেতে তাঁত বোর্ডের নেওয়া এই প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে  ১২ কোটি ১০ লাখ টাকা। এতে মসলিনের প্রযুক্তি উদ্ধার করা হবে। পুরো প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড সূত্রে জানা যায়,  এই বিনিয়োগ বা গবেষণা প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করার জন্য এ প্রকল্পের আওতায় মূলত মসলিন কাপড় তৈরির জন্য তুলাগাছ লাগানো হবে। পরে সেই তুলা থেকে সুতা তৈরি করে মসলিন কাপড় বানানো হবে। এজন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মসলিন কাপড় তৈরি উপযোগী সুতা তৈরির জন্য কিছু তুলাগাছ লাগানো হয়েছে। ইতোমধ্যে সেসব গাছে ফুলও ধরতে শুরু করেছে। এরপর তুলা সংগ্রহ করে নমুনা হিসেবে সুতা ও কাপড় তৈরি করা হবে।
প্রাচীন যুগে তাঁতিরা যে পদ্ধতিতে মসলিন বুনতো সেই পদ্ধতি তাঁদের নিজস্ব প্রযুক্তি। তাঁদের হারানো সেই প্রযুক্তি পুনরুদ্ধার করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড কর্তৃক গৃহীত হারানো মসলিন পুনরুদ্ধার করার জন্য তিনটি উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে মসলিনের সুতা ও কাপড় তৈরির প্রযুক্তি পুনরুদ্ধার; দ্বিতীয়ত, পরীক্ষামূলকভাবে মসলিনের সুতা ও কাপড় তৈরি এবং তৃতীয়ত, বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিনের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার।
এ প্রকল্পের আওতায় মসলিন সুতা ও কাপড় তৈরির প্রযুক্তি বিষয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁতিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু এলাকার তাঁতিদের প্রাধান্য দেয়া হবে। এলাকাগুলো হলো ঢাকার ধামরাই; মানিকগঞ্জ সদর ও শিবালয়; টাঙ্গাইলের নাগরপুর, ভূঞাপুর ও মধুপুর; গাজীপুরের কাপাসিয়া; নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জ; নরসিংদী সদর ও পলাশ; ময়মনসিংহ সদর; কুমিল্লার চান্দিনা; বান্দরবান সদর; খাগড়াছড়ি সদর; রাঙামাটি সদর; রাজশাহী শহর ও যশোর সদর।
মসলিন বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যের প্রতীক। মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা, গ্রিক পর্যটক পিনটনি, টেইলর, উরে প্রমুখ তাঁদের লেখায় বাংলার মসলিনের বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলের মাধ্যমে জানা যায় যে মসলিন বস্ত্র প্রাচীনকাল থেকে প্রচলন থাকলেও ঢাকাই মসলিন মোগল আমলে প্রসিদ্ধ হয়। মোগল আমলে ঢাকাই মসলিন দেশ-বিদেশে প্রায় একচেটিয়া বাজার দখল করে। সতেরো শতকের প্রথম দিকে পর্তুগিজরা মসলিনের ব্যবসা করত। ওই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অন্য ইউরোপীয় বণিক, যেমন ওলন্দাজ ও ফরাসি কোম্পানি ঢাকা শহরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তারাই মসলিনের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন যুগের সূচনা করে। ইংরেজ কোম্পানি আমলে মসলিন শিল্পের অবনতি হয়। একপর্যায়ে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমান সরকারের উদ্যোগে আবার দেশে ফিরে আসবে দেশের হারানো সেই ঐতিহ্য। আবারো প্রসিদ্ধ হবে দেশের বুনন শিল্প এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সকলে।

No comments:

Post a Comment