Saturday, September 22, 2018

আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির লেখনীতে এস কে সিনহা

সম্প্রতি এস কে সিনহার লেখা একটি বইকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহলে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তার লেখা বইয়ে তিনি সরকারের নানা রকম সমালোচনা করেছেন, পাশাপাশি সরকারের বিরুদ্ধে তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা সহ নানাবিধ অভিযোগ করেছেন। এবারই প্রথম নয়, এর আগেও একাধিকবার বিভিন্ন কর্মকান্ড কিংবা বিতর্কিত মন্তব্য করে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। কেমন প্রকৃতির মানুষ কিংবা বিচারপতি ছিলেন এস কে সিনহা? সেই সম্পর্কে এক লেখাতে আলোকপাত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। যিনি দীর্ঘদিন এস কে সিনহার সাথে এক সাথে বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন। এস কে সিনহাকে নিয়ে গত আগস্ট মাসে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এর  লেখা কলামে উঠে এসেছে এস কে সিনহা সংশ্লিষ্ট নানা ঘটনা। তিনি লিখেছেন,
‘বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের আগের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এটা পরিষ্কার যে, বিচারপতি সিনহা পাকিস্তানী স্টাইলে সাংবিধানিক ধারায় আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাতের চেষ্টার প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আর পাকিস্তানী স্টাইলের কথা তো তিনি প্রকাশ্য আদালতেই বলেছিলেন। কিন্তু তার বিধি যে বাম। যথা সময়েই তার ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে যায়। বের হয়ে আসে তার হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণাদি। ধন্যবাদ জানাতে হয় আমাদের নিপুণ এবং একনিষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং অনুসন্ধান সাংবাদিকদের, যারা এসব তথ্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন। আপীল বিভাগের অন্য চার বিচারপতি এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির সঙ্গে না বসার সিদ্ধান্ত নেয়ায় তার দুরাশা ভেস্তে যায়, দেশও বেঁচে যায়।
এ তো গেল অতীতের কথা। কিন্তু শঙ্কার কথা হলো এই যে, আরও দুটি খবর এসেছে যা সত্যি ভয়ঙ্কর, যা বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে ঘিরে। প্রথমটি এসেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকে। তিনি কোন রাখঢাক না রেখেই যা ব্যক্ত করেছেন তা হলো, সম্প্রতি বিচারপতি সিনহা নিউইয়র্কে গিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর ভাই মীর মামুনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা গ্রহণ করেছেন। জয় অত্যন্ত স্বচ্ছ ভাষায় এও বলেছেন যে, তার কাছে এ ব্যাপারে প্রমাণ রয়েছে।
তৃতীয় সংবাদটির উৎস দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক শ্রী শংকর কুমার দে। শ্রী দে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ১৪ আগস্ট সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন তার শিরোনাম ছিল ‘সরকারবিরোধী নতুন ষড়যন্ত্রের মধ্যমণি এখন সিনহা।’ দীর্ঘ এই লেখাটির মূল কথা হলো, যুদ্ধাপরাধীরা প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে প্রচুর অর্থ প্রদান করছে তিনি যেন এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। শ্রী দে আরও উল্লেখ করেছেন বিচারপতি সিনহা এ টাকা দিয়ে একটি বই লিখছেন যাতে বর্তমান মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার থাকবে। শংকর কুমার দে যে বইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন তার কথা আমি আগেই অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এক সূত্র থেকে শুনেছিলাম এবং এও শুনেছিলাম সিনহা লন্ডনপ্রবাসী একজনকে অনুরোধ করেছিলেন তার বইটি লিখে দেয়ার জন্য।
পাঠকগণ নিশ্চয়ই অবগত আছেন, মীর কাশেম আলীর রায়ের পূর্বে সিনহা এই মামলা নিয়ে বহু নাটক এবং টালবাহানা করেছেন যার থেকে সংশ্লিষ্ট সকলেই এই মর্মে শঙ্কিত হয়েছিলেন যে, বিচারপতি সিনহা মীর কাশেম আলীর থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পকেটস্থ করেছেন। এই যৌক্তিক শঙ্কার কারণেই দুজন মন্ত্রীসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সরব বেশ কয়েকজন একটি গোলটেবিল বৈঠক করে সিনহার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। এর ফলে সিনহা পরে দুজন মাননীয় মন্ত্রীকে আদালত অবমাননার জন্য অর্থদন্ডে দন্ডিত করেছিলেন, যদিও তাদের কাছে নির্ভুল প্রমাণ ছিল যে, সিনহা মীর কাশেম আলীকে বাঁচানোর চেষ্টায় লিপ্ত।
আজ বিচারপতি সিনহা সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে তা দেখে বার বার আক্ষেপের সঙ্গে একটি কথাই মনে পরছে। সেটি হলো, আজ থেকে তিন বছর পূর্বে যখন আমি, স্বদেশ রায় এবং এ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন দোলন বিচারপতি সিনহার স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টায় লিপ্ত ছিলাম দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে। তখন অনেকেই আমাদের বিশ্বাস করতে চাননি বরং বলতেন আমরা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে তার বিরুদ্ধে বলছি। কিন্তু আমি তো তার কথোপকথন থেকে বুঝেই বলতাম যে, তার এজেন্ডা ছিল এ সরকারের পতন ঘটানো। তার দুর্নীতির তথ্য তো আমরা অনেক সূত্র থেকেই জেনেছি এমনকি সিঙ্গাপুর থেকেও। সাকার মামলার রায়ের আগে অনুরুদ্ধ কুমার রায় নামক এক ব্যবসায়ীকে নিয়ে লন্ডনের গ্লোস্টার মিলেনিয়াম হোটেলে দূতাবাসের মাধ্যমে বৈঠক করা ইত্যাদি খবর তো আগেই জেনেছি।
এ ব্যাপারে স্বদেশ রায়ের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগেই লিখেছিলেন, যে লোক ১৯৭১-এ শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন, তিনি আপীল বিভাগ কেন কোন আদালতেরই বিচারক হতে পারেন না। এ কারণে বিচারপতি সিনহার চিরাচারিত ক্ষোভ ছিল স্বদেশ রায়ের বিরুদ্ধে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভাষ্য প্রমাণ করছে যে, মীর কাশেম আলী পরিবারের সঙ্গে সিনহ্ার আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল এবং তিনি মীর কাশেম আলীর রায়ের পূবেই তার থেকে প্রচুর অর্থ পকেটস্থ করেছিলেন বলে যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন তাদের বিশ্বাসে যুক্তি ছিল। তবে পরিস্থিতির চাপে সিনহ্া মীর কাশেম আলীকে খালাস দিতে পারেননি। প্রসিকিউশন মামলা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে ইত্যাদি কত কথাই না সিনহ্া বলেছিলেন মীর কাশেম আলীকে খালাস দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য। দুই-দুইবার, বেঞ্চের অন্য বিচারপতিদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও, সময় বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
যে বিষয়টিতে আমি সবচেয়ে বিস্মিত এবং শঙ্কিত হয়েছিলাম সেটি ঘটেছিল ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। বিচারপতি সিনহা বঙ্গ ভবনে প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথ নিয়ে আদালতে ফিরেই আপীল বিভাগের ১নং কোর্টের তালিকা থেকে আমার নাম কর্তন করে দেন। ১নং কোর্টে যুদ্ধাপরাধীদের আপীলের শুনানি হচ্ছিল এবং আমি আপীল বিভাগে পদোন্নতি পাওয়ার পর থেকে ১নং কোর্টেই ছিলাম এবং যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, সাঈদী এবং কামারুজ্জামানের আপীল শুনেছি তাদের সকলের বিরুদ্ধেই, সাঈদীসহ ফাঁসির রায় দিয়েছি। তদুপরি ১নং কোর্টে ব্যারিস্টার মওদুদের বাড়ির আপীলও ছিল। সে মামলাও আমি আংশিকভাবে শুনেছি। আমাকে ১নং কোর্ট থেকে সরিয়ে দেয়ায় বিসিত হয়ে ২০১৫ সালের ১৭ জুন আমাকে ১নং কোর্ট থেকে ২নং কোর্টে পাঠানোর কারণ জিজ্ঞেস করলে প্রধান বিচারপতি সিনহা অকপটেই বলে ফেললেন যে, সাকা চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের দাবি অনুযায়ী তিনি আমাকে সাকার মামলা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। তিনি বললেন, সাকার পরিবার কোনভাবেই আপনাকে (মানে আমাকে) এই মামলার জন্য মেনে নিতে পারছিল না। আমি তখন প্রধান বিচারপতি সিনহাকে বললাম, প্রধান বিচারপতি হিসেবে বেঞ্চ গঠনের ক্ষমতা একান্তই আপনার। কিন্তু আপনি কি করে আসামিদের কথায় বেঞ্চ গঠন করেন? আমি আরও বললাম- সবচেয়ে বড় কথা আপনার আদালতে যাদের মামলা বিচারাধীন তাদের সঙ্গে আপনি কি করে দেখা করেন? বিচারপতি সিনহা আমার এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। তিনি আরও বলেছিলেন, ব্যারিস্টার মওদুদ তার (সিনহার) হাতে-পায়ে ধরে বলেছিলেন, আর যাকেই তার আপীল শুনানিতে রাখা হোক না কেন বিচারপতি মানিককে যেন না রাখা হয়।
প্রধান বিচারপতি সিনহার সঙ্গে আমার সেদিনের কথোপকথন শুধু রেকর্ডই হয়নি, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। প্রচারিত হয় ৭১ টেলিভিশনে, যার ফলে সিনহা আর সাকার পক্ষে রায় দিতে সাহস করেননি। এরপর বিচারপতি সিনহা এ বিষয়ে লেখার কারণে স্বদেশ রায়ের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করলে স্বদেশ রায় যখন ওই রেকর্ড প্রকাশ্য আদালতে বাজাতে উদ্যত হন তখন বিচারপতি সিনহা আদালতে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তিনি আসলেই সাকার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছেন। আইনত এই স্বীকারোক্তির পরই বিচারপতি সিনহার পদত্যাগ করা বাঞ্ছনীয় ছিল। পৃথিবীর যে কোন দেশেই তাই হতো। বিচারপতি সিনহা ৭১ চ্যানেলের রূপা এবং মোজাম্মেল বাবুর বিরুদ্ধেও আদালত অবমাননার মামলা করেছিলেন, যদিও সেটা নিয়ে আর এগুবার সুযোগ পাননি।
সিনহা সরকার পতনের উদ্দেশ্য নিয়ে এগুচ্ছে এ কথা বললেও ৭১ চ্যানালসহ দু’একটি টেলিভিশনই শুধু এটি প্রচার করেছে। অন্যেরা আমার এবং স্বদেশ রায়ের কথাকে মোটেও গুরুত্ব দেননি ভেবেছেন আমরা জিঘাংসা বশত এগুলো বলছি। আজ আমাদের গর্ব এই যে সিনহার দুর্নীতি এবং সরকার উৎখাতের এবং সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির যে কথা আমরা তিন বছর আগে বলেছিলাম আজ তা কাগজে-কলমে প্রমাণিত হয়েছে। সেদিন লন্ডনপ্রবাসী স্বনামধন্য কলামিস্ট গাফ্ফার চৌধুরী সাহেবও, যার সঙ্গে আমার বহু দশকের নিবিড় সখ্য রয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তার লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলার ডাক পত্রিকায় যার সঙ্গে সামান্য হলেও কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছিল, যিনি আমাকে বিচারপতি কাইয়ানির সঙ্গে তুলনা করে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যাকে অমি সবসময়ই শ্রদ্ধাভরে দেখি, তিনিও সিনহার পক্ষ হয়ে আমার বিরুদ্ধে বেশ ক’টি প্রবন্ধ লিখেছেন। আশা করি এখন তার ভুল ভেঙ্গেছে। তিনি নিশ্চয়ই পুরো বিষয়টি আঁচ করতে পারেননি, সিনহাকে চিনতে পারেননি।
সিনহা দুর্নীতির মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য দেশান্তরে চলে গেছেন। ৭১ চ্যানেলের এক টকশোতে আমি বলেছিলাম বিচারপতি সিনহাকে ১/১১ এর সময় দুর্নীতির জন্য পদত্যাগ করতে বলেছিলেন সে সময়ের রাষ্ট্রপতি। আমার এই কথা শুনে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক, যার নাম আজ মনে নেই, আমার বক্তব্যকে ইমরাল বা অনৈতিক বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই অধ্যাপক আজ সব কিছু জানার পর নিশ্চয়ই লজ্জিত হয়েছেন বলে আমি আশা করছি।
প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগেই সিনহা ১/১১-এর অন্যতম কুশীলব একজন ক্ষমতাধর আইনজ্ঞের প্রভাবে চলে আসেন। ১/১১-এর সময় সিনহাসহ হাইকোর্ট বিভাগের মোট তিনজন বিচারপতিকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে তলব করে তাদের দুর্নীতির সকল প্রামাণ্য দলিল দেখান এবং তাদের পদত্যাগ করতে বললে শুধু একজন পদত্যাগ করেন। সিনহা মায়ের অজুহাত দেখিয়ে দুদিন পরে আসবেন বলে পদত্যাগ না করেই চলে আসেন এবং সেই ১/১১-এর কুশীলব প্রভাবশালী আইনজ্ঞের শরণাপন্ন হন, যিনি তখন সিনহাকে রক্ষা করেন। সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর এই কুশীলব তার ঘাড়ে চেপে বসেন এবং এই সরকারকে উৎখাত করার জন্য পরামর্শ দেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর ওই কুশীলব আইনজ্ঞ প্রকাশ্যেই বলেছিলেন তিনি প্রধান বিচারপতি সিনহাকে প্রতিনিয়ত পরামর্শ দেবেন, যে কথাটি জাতীয় দৈনিকসমূহে ছাপা হয়েছে। সেই কুশীলব প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন লোকের সাহায্যে সিনহার সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। সেই কুশীলব সিনহাকে পাকিস্তানের তুলনা এনে বলতেন পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্ট যদি তিন তিনজন প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে পারে তাহলে আপনি কেন পারবেন না। এর মধ্যে একটি সুযোগও সেই কুশীলবরা তৈরি করে দিয়েছিলেন। তার যে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি বিফল রিট করিয়েছিলেন এই কুশীলব। যদিও তিনি নিজেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
হাইকোর্টে রিটটি বিফল হওয়ায় ওই কুশীলবের প্ররোচনায় আপীল বিভাগে আপীল করা হয় এবং সিনহার পদত্যাগের পূর্বে যে কোন সময় এটি শুনানি করে ওই ১৫৩ জনকে অবৈধ ঘোষণা করে সংসদ তথা সরকার অবৈধ এ ধরনের রায় দেয়ার সমস্ত প্রস্তুতিই শেষ করেছিলেন বিচারপতি সিনহা। আর মাত্র কয়েকদিনের ব্যাপার ছিল। আর ক’দিন ক্ষমতায় থাকতে পারলেই তিনি এটি করতেন বলে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। সিনহা তাকিয়ে থাকতেন পাকিস্তানের দিকে। এর কারণও রয়েছে। তিনি প্রকাশ্য আদালতেই বলেছিলেন, ’৭১ এ তিনি শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে পাকিস্তানী সৈন্যদের পক্ষে কাজ করেছেন। পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্টের ভয়ও তিনি এ্যাটর্নি জেনারেলকে দেখিয়েছিলেন প্রকাশ্যে আদালতে। কিন্তু বাংলাদেশ তো পাকিস্তান নয়। মিয়ানমারের মতো পাকিস্তান তো পর্দার আড়াল থেকে শাসন করছে সে দেশের সেনাবাহিনী। সেদেশে গণতন্ত্র কখনও খুঁটি গাড়তে পারেনি। আর আমাদের দেশে রয়েছে গভীর গণতন্ত্রের ভীত্তি, আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরই ফসল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা গণতন্ত্রের ঐতিহ্যে লালিত এই বাহিনীর দেশপ্রেম এবং গণতন্ত্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত।
আমাদের পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি সিনহাও ১/১১-এর কুশীলবদের, যাদের মূল ব্যক্তি হচ্ছেন একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ, প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র এবং প্রত্যক্ষ মদদে বলিয়ান হয়ে পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্ট স্টাইলে আমাদের দেশেও বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করে ফেলেছিলেন।
১/১১-এর কুশীলবরা তাকে রাষ্ট্রপতি পদে পদায়নের লোভ দেখিয়েছিলেন। তদুপরি ভারতের প্রখ্যাত এবং জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শ্রী মানস ঘোষ কলকাতার দ্য স্টেটসমেন পত্রিকায় লিখেছিলেন- বিচারপতি সিনহা লন্ডন ভ্রমণকালে খালেদা জিয়ার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বিচারপতি সিনহাকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলে বিচারপতি সিনহ্াকে রাষ্ট্রপতির পদ দেয়া হবে।
এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই সমস্ত পুরনো ঐতিহ্য ভঙ্গ করে প্রায় প্রতিদিনই বিচারপতি সিনহা কোথাও না কোথাও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে থাকেন এই বলে যে, দেশে গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই, সংসদ সদস্য অযোগ্য, অশিক্ষিত, নির্বাচন কমিশন অযোগ্য ইত্যাদি। তার অতীত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায়ও সিনহা দমেননি। নতুন করে শিং বাঁকাতে চেষ্টা করছেন। তিনি ভাবতে পারছেন না অতীতের মতো এখনও তার সব ষড়যন্ত্রই তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে, বুঝতে পারছেন না বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়।
১৬ সংশোধনী মামলায় সিনহা নিজে মামলার বিষয়বস্তু থেকে শত শত মাইল দূরে সরে যেয়ে এমন সব কথা বলেন যার সঙ্গে মামলার বিষয়বস্তুর কোন সম্পর্কই ছিল না যদিও আপীল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতিগণ তাদের নিজেদের লেখা আলাদা অবজারভেশনে মামলার ইস্যুর বাইরে কিছুই লেখেন নি। বিচারপতি সিনহা তার অবজারভেশনে এসব কথা লিপিবদ্ধ করে জনমনে এ সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
জাতির সৌভাগ্য সিনহার দুর্নীতির প্রমাণগুলো জনসমক্ষে এসে গেলে আপীল বিভাগের বাকি চারজন বিচারপতি এই দুর্নীতিবাজ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে অস্বীকার করলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সেই সঙ্গে দেশও বেঁচে যায়। আমি মনে করি, সিনহাকে দেশে ফিরিয়ে এনে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলো চালু করা হলে তার বিষদাঁত ভেঙ্গে যাবে।’
আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতির লেখা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, অনেক আগে থেকেই দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন  এস কে সিনহা। উল্লেখ্য গত মাসে লেখা এই কলামে যে বইটির লিখার জন্য লন্ডন প্রবাসী একজনকে অনুরোধ করার ব্যাপারটি উল্লেখ করা হয়েছে  মূলত এই বইটিই সম্প্রতি এস কে সিনহার নামে প্রকাশিত হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই বোঝা যাচ্ছে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই একটি বিশেষ মহলের ইন্ধনে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছেন এস কে সিনহা।

No comments:

Post a Comment